মহাবিশ্ব কতটা বড়? যেহেতু প্রতিনিয়ত মহাবিশ্ব বড় হচ্ছে সেহেতু এই প্রশ্নটার একটা সহজ উত্তর হচ্ছে ‘অসীম’। কিন্তু উত্তরটা অনেকের জন্যই সন্তোষজনক নয়। অসীম তো বুঝলাম, কিন্তু ফিল কিভাবে করব? আসলে ফিল করা পসিবলও না। তবে খানিকটা আঁচ করা যেতে পারে। আজকে আপনাকে খানিকটা আঁচ করানোর চেষ্টা করব।
বিষয়সূচি
মহাবিশ্বের অসীমতা
ধরে নিলাম এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের সীমানা আমার অবস্থান থেকে ক কিলোমিটার দূরে। আমি ক কিলোমিটার পাড়ি দিলেই মহাবিশ্বের প্রান্তে পৌঁছে যাব। ধরে নিলাম আমি ১ সেকেন্ডেই এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারি। আমি আমার মহাকাশযানে চড়ে শেষ ১ সেকেন্ডে ক কিলোমিটার গেলাম। কিন্তু একি! মহাবিশ্বের প্রান্ত দেখছি আরো দূরে! কারণ মহাবিশ্ব বাড়ছেই। আমি যেই ১ সেকেন্ডে প্রান্তে পৌঁছাব ততক্ষণে মহাবিশ্ব আরো বিশাল হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, এটাই অসীম। যার কোন সীমানা বা প্রান্ত নেই কিংবা সেই সীমানা পরিমাপ করতে পারি না।
আলোকবর্ষ কি?
আচ্ছা এবার একটু আঁচ করা যাক, মহাবিশ্ব কত বড় হতে পারে। এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল কোনটি? এটার উত্তর সবারই জানা। সেটা হচ্ছে আলোর কণা বা ফোটন কণা। এর বেগকে আমরা আলোর বেগ বলে থাকি। আলো বা ফোটন কণা ১ সেকেন্ডে 3×10⁸ মিটার চলে যায়। সংখ্যাটা দেখতে ছোট লাগলেও আদতে এত ছোট নয়। প্রথমে একটি কাগজে 3 লিখুন, তারপর আটটি 0 দিন। অনেক বড় একটি মান, তাই নয় কি?
চলুন এবার একটি নতুন একক সম্মন্ধে যান যাক। আলো এক সেকেন্ডে কতটা দূরত্ব পাড়ি দেয় তা তো জানলাম। এবার আলো এক বছরে কত দূরত্ব পাড়ি দেয় সেটা জানবো। আলোর বেগকে 60×60×24×365 অর্থাৎ এক বছরে যত সেকেন্ড হয় তা দিয়ে গুণ করে পাই, 9.46×10¹⁵ মিটার। অর্থাৎ আলো এক বছরে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করে। এটাকে ১ আলোকবর্ষ বলে, যা দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দূরত্ব মাপা হয়। কেননা সেখানে কিলোমিটার অনেক ক্ষুদ্র একক। সেজন্যই আলোচনার শুরুতে এই এককের সাথে পরিচয় করিয়ে নিলাম। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরো কিছু বড় একক ব্যবহার করা হয়। আপাতত এটা দিয়েই বোঝাই।
আলফা সেন্টরি
একটু আগেই দেখলাম, আলো তীব্র বেগে চলে। আলো এতটা তীব্র বেগে আলো চলার পরেও আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র অর্থাৎ আলফা সেন্টরির (Alpha Centauri) থেকে আলো এই পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৪.৩৭ বছর! ভাবা যায়, কাছের নক্ষত্রই যদি এতটা দূরে থাকে তবে দূরেরগুলো কোথায়? চলুন এবার দূরের দিকে হাত বাড়াই। দেখি মহাবিশ্ব আমাদের কত দূর পর্যন্ত জানাতে পারে! 😮
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি
আমাদের সৌরজগতের সম্মন্ধে সবারই কমবেশি ধারণা আছে। আমাদের সৌরজগতের মত অনেকগুলো সৌর জগৎ মিলে একটি গ্যালাক্সি তৈরি হয়। প্রতিটা সৌরজগতেই আছে নক্ষত্র। যাকে আবর্তন করে ঘুরছে পৃথিবীর মতো অসংখ্য গ্রহ। যদি আমাদের গ্যালাক্সি অর্থাৎ মিল্কিওয়ের কথাই বলি, এই মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব ২,০০,০০০ বা ২ লক্ষ আলোকবর্ষ! মানে, আলোর বেগে গেলেও দুই লক্ষ বছর লাগবে শুধু মিল্কিওয়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে! এবার ভাবুন, পুরো মিল্কিওয়ে ঘুরতে কত কোটি আলোকবর্ষ লাগবে? 😮
লোকাল গ্রুপ ও সুপারক্লাস্টার
কি ঘাবড়ে গেলেন? নাহ, এখানেই শেষ নয়। এত বিশাল গ্যালাক্সি মহাবিশ্বের খুব ছোট একটা অংশ। আমাদের গ্যালাক্সিসহ ৫৫ টি গ্যালাক্সি একত্র হয়ে তৈরি করে লোকাল গ্রুপ। এই লোকাল গ্রুপের বিস্তৃতি ১,০০,০০,০০০ বা ১ কোটি আলোকবর্ষ! আবার ১০০+ লোকাল গ্রুপ মিলে তৈরি হয় বিশালাকৃতির মহাজাগতিক গ্যালাক্সি-গুচ্ছ যার নাম ভার্গো সুপারক্লাস্টার। এর ব্যাস প্রায় ১১,০০,০০,০০০ বা ১১ কোটি আলোকবর্ষ!
লানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টার
কিন্তু এটাও হয়রানি হবার কিছু নেই। এই সুপারক্লাস্টারও মহাবিশ্বের ছোট একটা অংশ! 😁 এরকম আরো ২০-৩০ টি সুপারক্লাস্টার একত্র হয়ে তৈরি করে গ্রেইট লানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টার নামক একটি বৃহৎ গ্যালাক্সি-গুচ্ছ। যেখানে আছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মত ১ লক্ষ+ গ্যালাক্সি! এই লানিয়াকেয়ার ব্যাস প্রায় ৫২,০০,০০,০০০ বা ৫২ কোটি আলোকবর্ষ! আবারও হতাশ করার জন্য বলছি, এই গ্রেইট লানিয়াকেয়া নামক গ্যালাক্সি-গুচ্ছ পুরো মহাবিশ্বের তুলনায় খুবই সামান্য এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র! 😱
সর্ববৃহৎ সুপারক্লাস্টার
এখন পর্যন্ত আবিস্কার হওয়া সুপারক্লাস্টারের মধ্যে সর্ববৃহৎ হল হারকিউলিস-করোনা বরিয়ালিস গ্রেইট ওয়াল! এটি আবিস্কৃত হয় ২০১৪ সালে। এটা এতটাই বড় যে, এটিকে ঘুরে আসতে সময় লাগবে ১০০০,০০,০০,০০০ বা ১ হাজার কোটি আলোকবর্ষ (১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ)! 😰 অথচ আমাদের মহাবিশ্বের বয়সই ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ! এরচেয়েও বড় সুপারক্লাস্টার থাকার কথা। কিন্তু সেগুলো আমাদের মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণযোগ্য (Observable Universe) অংশের বাইরে।
অপর্যবেক্ষণযোগ্য অংশ
এতক্ষণ যা আলোচনা করছিলাম, সেগুলো বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে। কিন্তু মহাবিশ্বের বিস্তৃতি আরো বিশাল, যা কিনা বিজ্ঞান এখনো পর্যবেক্ষণই করতে পারে নি। যাকে বলা হয় মহাবিশ্বের অপর্যবেক্ষণযোগ্য (Unobservable Universe) অংশ। মূলত বিগ ব্যাং প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে হওয়ায় এর চেয়ে বেশি দূরত্বের কোন কিছু থেকে আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছোয় নি। ফলে সে অংশগুলো সম্মন্ধে আমরা ধারণা করতে পারছি না।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মিহরান এবং তার সহকর্মীরা ধারণা করতে পেরেছেন, আমাদের মূল মহাবিশ্বের আকার আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের চেয়ে প্রায় ২৫০ গুণ বড়! ভাবা যায়?
শুধু তাই নয়, নাসা জানিয়েছে আমরা মহাবিশ্বের কেবল মাত্র ৫% জানি। বাকি ৯৫% আমরা জানতে পারি না! অথচ এই ৫% জেনেই তো মহাবিশ্বের কূল-কিনারা পাওয়া দুষ্কর। ভাবুন তবে মহাবিশ্বের অজানা অংশের পরিমাণ কেমন? তাই ধরে নেয়া হয়েছে এই ৯৫% অংশের মধ্যকার ২৭% হল ডার্ক ম্যাটার (Dark Matter) এবং ৬৭% হল ডার্ক এনার্জি (Dark Energy)। ডার্ক ম্যাটার ও এনার্জি নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করব।
স্রষ্টার অস্তিত্ব
আচ্ছা, এই মহাবিশ্বে যদি এত বিশাল বিশাল সুপারক্লাস্টারের আকার ক্ষুদ্র বিন্দুর মত হয় তবে, আমরা কতটুকু? আসলে নিজেদেরকে শূন্য বললে বললে বোধকরি ভুল হবে না। এই শূন্য মানুষ হয়ে আমাদের চেয়েও ছোট আকৃতির মস্তিষ্কের ব্যবহার করে যদি আমরা এই বিশাল মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছে কিনা সেটা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করতে বসি আমার মতে এরচেয়ে হাস্যকর বিষয় বোধহয় আর কিছুই হবে না।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, মাত্র ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ আমাদের সীমানা। এর বাইরে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। মহাবিশ্বের মাত্র ৫% জানতে পারি। অথচ স্রষ্টা হয়তো এরকম অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব তৈরি করে বসে আছেন। আর সেই স্রষ্টাকে আমরা আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে ধরাশায়ী করব? তিনি কি আমাদের জীববিজ্ঞান গবেষণাগারের অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে হাজির হয়ে বলবেন, “নাও, আমার অস্তিত্বের প্রমাণ!”? অবশ্যই নয়। মজার ব্যাপার হল, আমরা ত্রিমাত্রিক জগতের বাসিন্দা হওয়ায়, এর চেয়ে উপরের জগৎ অনুধাবন করতে সক্ষম নই। তার মানে এই নয় যে সেগুলো নেই। সেগুলো আছে কিন্তু আমাদের জ্ঞানের সীমার বাইরে। তাহলে, সেখানে সকল মাত্রার ঊর্ধ্বে থাকা স্রষ্টাকে বিজ্ঞান খোঁজা নেহাত বোকামিই।
আসলে এতটা সুনিয়ন্ত্রিত মহাবিশ্ব দেখলে যে কেউই মানতে বাধ্য হবেন যে, সৃষ্টিকর্তা আছেন। অবশ্যই তাকে থাকতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়াটা নিতান্তই অসম্ভব। না, এগুলো আমার মতামত নয়। বিজ্ঞানের প্রথম সারির বিজ্ঞানীগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে গেছেন।
পদার্থবিদ্যার রাজপুত্র স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেন,
“অভিকর্ষ গ্রহসমূহের গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এটি ব্যাখ্যা করতে পারেনা, কে গ্রহগুলোকে গতিশীল হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে দিলে। ঈশ্বর সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু ঘটা সম্ভব তার সবই তিনি জানেন।”
আর নোবেলজয়ী পদার্থবিদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেন,
“আমি যতই বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করি, আমি ততই স্রষ্টায় বিশ্বাসী হই”
অণুজীববিজ্ঞানের জনক লুই পাস্তুর বলেন,
“বিজ্ঞানে অল্প জ্ঞান আপনাকে স্রষ্টা থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, বেশি জ্ঞান আপনাকে স্রষ্টার নিকটে আনবে।”
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম উদ্ভাবক ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ বলেন,
“প্রকৃতিকে একটি গ্লাস ধরলে, এর উপরের অংশ আপনাকে নাস্তিক করে তুলবে। তবে নিচের অংশে প্রবেশ করলে দেখবেন, স্রষ্টা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
পরিশেষে বলার এটুকুই বাকি আছে যে, স্রষ্টা নিয়ে বিজ্ঞানের বিতর্ক কোনদিনও ছিল না। এমনকি বিজ্ঞান এটা প্রমাণও করে না স্রষ্টা নেই। কিংবা প্রমাণ করবার সক্ষমতাও বিজ্ঞানের নেই। তাই বিজ্ঞানকে টেনে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করা নিতান্তই অযাচিত বললে ভুল হবে না।